চট্টগ্রাম ব্যুরো: উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি এ কথা বলেন।
নৌকায় ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় উপস্থিত নেতাকর্মীদের কাছে ওয়াদা চান। তিনি বলেন, আপনারা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নৌকায় ভোট দেবেন কি-না, হাত তুলে ওয়াদা করুন। তখন নেতাকর্মীরা হাত তুলে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশে উন্নয়ন হয়। একমাত্র আমরা যদি নৌকা মার্কায় ভোট পাই তাহলেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের কারণেই এই দেশ বিধায় সবার আগে তাদের অধিকার।
মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, তিতীক্ষার জন্যই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, উন্নত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের কারণেই আজকের স্বাধীনতা, উন্নয়ন। মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি সবাই সর্বাগ্রে অধিকার ভোগ করবে। সে কারণে চাকরিতে আমরা কোটার ব্যবস্থা করেছি। এ সময় সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য যে ৩০ শতাংশ কোটা আছে, তা বহাল থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান আর নাতিপুতির জন্য চাকরিতে কোটা রয়েছে। কোটায় যদি না পাওয়া যায়, তাহলে শূন্য পদে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ দিতে কোটার বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারি হিসাব মতে, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য রয়েছে ৩০ শতাংশ কোটা। আর এর বাইরে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা রয়েছে।
সভায় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, আমরা উন্নয়ন করি। আর বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে দেশকে পিছিয়ে দেয়। বিগত নির্বাচন ঠেকানোর নামে খালেদা জিয়ার নির্দেশে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। খালেদা ও তার দুই ছেলে কালো টাকা সাদা বানিয়েছে। তাদের পাচারের টাকা বিদেশে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের মাটিতে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার দিয়ে সরকার তা পূরণ করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সমগ্র বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মসূচি তুলে ধরে বলেন, পুরো চট্টগ্রামে বর্তমান সরকার ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করছে। চট্টগ্রামের সব জায়গায় উন্নয়নের ছোঁয়া। শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা ১ কোটি ৩০ লাখ মায়ের হাতে উপবৃত্তির টাকা দিচ্ছি, যেন তাদের সন্তানেরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর ও উদ্বোধন করেন।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মো. মোশাররফ হোসেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সংসদ সদস্য ড. হাসান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, উপ দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এমএ সালাম প্রমুখ।
এদিকে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রাম মহানগরে জনসভা করার অনুরোধ জানিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নযজ্ঞ চলছে। আমাদের আর তেমন কোন চাওয়া নেই। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মহানগরে একটি জনসভা চাই।
দুপুরের সাথে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা। মাঠ ছাপিয়ে কলেজ রোডসহ আশপাশের কয়েক বর্গ কিলোমিটার জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লাল- সবুজ ক্যাপ, সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীর অনুসারীরা কমলা রঙের গেঞ্জি, ভূমি প্রতিমন্ত্রীর হলুদ টুপি, নগর ছাত্রলীগের লাল টুপিসহ অনেকেই একই রঙের পাঞ্জাবি, শাড়ি পরে শোভা বাড়িয়েছেন জনসভার।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া থানার মোড় এলাকায় দেখা গেছে, মিছিলে, স্লোগানে উজ্জীবিত নেতাকর্মীদের ¯্রােত জনসভাস্থলের দিকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পটিয়ার স্থানীয় সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছবি সম্বলিত পোস্টার ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে জনসভাস্থলের আশপাশ ও পুরো পটিয়া। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সংসদীয় আসন আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সম্ভাব্য পদপ্রত্যাশীরা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে বড় ব্যানার ছাপিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মহানগর ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবন্দরাও জনসভা মঞ্চে আসতে শুরু করেন। তবে জনসভার কারণে সৃষ্ট গণপরিবহন সংকটে ভোগান্তিতে পড়েন দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা। সকাল থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে গণপরিবহন কম থাকায় এ ভোগান্তির সৃষ্টি হয়।
এর আগে দুপুরে চট্টগ্রামের ডকইয়ার্ডে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ট প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। এ সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নৌবাহনীর পরিচিতি অনেক বেড়েছে বলে মন্তব্য করে বলেন, নৌবাহিনীর জাহাজ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে এবং নিজেরাও সফলভাবে মহড়ার আয়োজন করছে। উপমহাদেশে কেবল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজই ভূ-মধ্যসাগরে মাল্টিন্যাশনাল মেরিটাইম টাস্কফোর্সের আওতায় সফলভাবে নিয়োজিত থেকে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সমদ্রসীমা নির্ধারণের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা বিশাল সমুদ্র এলাকা অর্জন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সমুদ্র সম্পদকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্লু-ইকনোমির বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে নৌবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সমুদ্র পথে পরিবাহিত হয়। বিশাল এ সমদ্র এলাকার সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে নৌবাহিনী সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সমদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় মানব পাচার, চোরাচালান রোধ, জেলেদের নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতে করাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নৌবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
শেডে অল্পসংখ্যক সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিএন ডকইয়ার্ডে এখন ২৪টি ওয়ার্কশপ পরিচালিত হচ্ছে প্রায় ২ হাজার সামরিক-বেসামরিক জনবল দিয়ে। বিএন ডকইয়ার্ডের নিজস্ব ফ্লোটিং ডক ‘বিএনএফডি সুন্দরবন’ যাত্রা শুরুর পর থেকে দেশি-বিদেশি ৭০৭টি যুদ্ধজাহাজের সফল ডকিং ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া বিএন স্লিপওয়ে প্রায় ৩৬২ জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পন্ন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, থ্রিজি থেকে ফোরজি যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার করেছি। ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। মেট্টোরেল, পায়রাবন্দর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি।
সকাল সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকালে নেভাল একাডেমিতে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধান, নৌ সদরদফতরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। আধুনিক এই কমপ্লেক্সটি ১৬টি পৃথক ভবন ও অবকাঠামোর সমন্বয়ে নির্মিত। এতে একাডেমিক ভবন, ট্রেনিং উইং, ওয়ার্ডরুম, প্যারেড গ্রাউন্ড, সুইমিং পুল, বোট পুল ও বাসস্থানসহ অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে সী-ম্যানশীপ, এন্টি সাবমেরিন, গানারী ও কমিউনিকেশন মডেল রুম, চার্ট রুম, সুপরিসর লাইব্রেরি, কম্পিউটার ও ল্যাংগুয়েজ ল্যাব এবং আধুনিক অডিটোরিয়াম। এছাড়া বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে সাতটি বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানাগার।